হলিউড থেকে ইসলামের পথে : নব্বইয়ের দশকে ব্রিটিশ হলিউড জগতে অভিনয়ের মাধ্যমে মরিয়াম ফ্রাংকয়েস সেররাহ পরিচিত হয়ে ওঠেন। খুব ছোট বয়সে ‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’ নামের ফিল্মে অভিনয় করে সুনাম কুড়ান তিনি। এমিলি ফ্রাংকয়েস ছিল তাঁর পূর্ব নাম। ইসলাম গ্রহণের পর যুক্তরাজ্যে ইসলামসংশ্লিষ্ট ভিডিও সিরিজ ‘ইন্সপায়ার্ড বাই মুহাম্মদ’ তৈরি করে আবারও খ্যাতি লাভ করেন।





ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা : মরিয়াম ফ্রাংকয়েস যুক্তরাষ্ট্রের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ ও রাজনীতি বিজ্ঞানে স্নাতক করেন। এখানে পড়া সমাপ্ত করে ২০০৩ সালে ২১ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।লন্ডনের এসওএএস ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ইসলামিক স্টাডিজের গবেষণা সহকারী হিসেবে মারয়াম কাজ করেন।





লেখালেখি ও সাংবাদিকতার জীবন : মরিয়াম ফ্রাংকয়েস বিবিসি ওয়ানের ‘দ্য বিগ কোয়েশ্চেন’ প্রগ্রাম ও সানডে মর্নিং লাইভের নিয়মিত অতিথি, টিআরটি ওয়ার্ল্ডের ফ্রেঞ্চ রাজনীতিবিষয়ক প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তী সময়ে আলজাজিরার হেড টু হেড প্রগ্রাম প্রডিউসার হিসেবে কাজ করেন। চ্যানেল ফোরে তিনি দ্য ট্রুথ অ্যাবাউট মুসলিম ম্যারেজ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। এ ছাড়া হাফিংটন পোস্ট, নিউজ নাইট, ফোর থট টিভি, বিবিসি নিউজ, ক্রোসটক, বিবিসি রেডিও, স্কাই নিউজসহ বহু টিভি ও সংবাদমাধ্যমে কাজ করেন। ২০১৭ সালে ইউরোপের তরুণ নেতাদের মধ্যে ফোরটি আন্ডার ফোরটি-এর তালিকায় মনোনীত হন।





সংশয়বাদী ক্যাথলিক পরিবারের সদস্য : মরিয়াম বলেন, কেমব্রিজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে আমি ইসলাম গ্রহণ করি। এর আগে আমি একজন সংশয়বাদী ক্যাথলিক পরিবারের সদস্য ছিলাম, যারা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় রূপকে অস্বীকার করে। বেশি কিছু বিষয় আমার জীবনে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে। প্রথমত মহানবী (সা.)-এর জীবনী ও পবিত্র কোরআন সম্পর্কে গভীর ভাবনা আমাকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। আমার মনে হয়, প্রচলিত ইতিহাসে যাদেরকে অত্যন্ত ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তদের অন্যতম হলেন মুহাম্মাদ (সা.)।





সন্ত্রাসী হামলার পরও মুসলিম সহপাঠীদের দৃঢ়তা : ৯/১১-এর হামলার পর বন্ধুদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক মনোভাবের অংশ হিসেবে আমার মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে। কারণ অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতো আমিও নিশ্চিত ছিলাম যে এই দুর্ঘটনার জন্য ইসলাম ধর্মই দায়ী। আমি বুঝতে চাচ্ছিলাম, আমার বন্ধুরা এখনও কেন এই বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে আছে? পরবর্তীতে আমি বুঝতে পারি যে, এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ইসলামের মূল বার্তা শান্তি, সম্প্রীতি, সংযমের বিপরীত বার্তা সমাজে ছড়িয়ে দেয়। আমি আরো উপলব্ধি করি যে, ৯/১১ এর ঘটনার পেছনে ছিল বিকৃত আদর্শের কিছু উগ্রবাদী যারা নিজেদের কাজের ন্যায্যতা প্রকাশের জন্য ইসলামকে ব্যবহার করেছিল। অথচ ইসলাম সর্বদা ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপনের কথা বলে।





কোরআন পাঠে জীবনের নানা প্রশ্নের জবাব : ইসলাম গ্রহণের পর থেকে পবিত্র কোরআন আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। আগে তা আমি রাগের বশে পড়তাম। কেননা তখন মুসলিম বন্ধুদের ভুল প্রমাণের চেষ্টায় তা পড়া হতো। কিন্তু এখন নিজের জীবনকে সুন্দর করতে খোলা মনে তা পড়ি। পবিত্র কোরআনের প্রথম সুরা ফাতিহা আমাকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে খুবই নাড়া দেয়। তা ছাড়া খ্রিস্টবাদ সম্পর্কে আমার বহু সন্দেহের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। তা পাঠ করে আমি হঠাৎ উপলব্ধি করি যে আমার ভাগ্য ও কর্মের পরিণতির জন্য আমি নিজেই দায়ী থাকব। ক্যান্ট, হিউম, সার্ত্রে ও অ্যারিস্টটলে ভাবনা একত্রিত করে পবিত্র কোরআন দীর্ঘকাল ধরে মানব অস্তিত্ব নিয়ে উত্থাপিত গভীর দার্শনিক প্রশ্নের জবাব দেয়।
তাছাড়া মৌলিক একটি প্রশ্ন ‘আমরা এখানে কেন’-এর উত্তরও প্রদান করে। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা ভেবেছিল যে আমি অন্য কোনো ধাপ পার করছি ও অপরিবর্তিত হয়ে উঠব। তখনো বুঝতে পারছিলাম না যে পরিবর্তনটি আরো অনেক গভীর ছিল। কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমাকে সমর্থন করে আমার সিদ্ধান্তগুলো বোঝার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল। শৈশবের কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। তাদের মাধ্যমে আমি ঐশী বাণীর সর্বজনীনতা উপলব্ধি করি। আমি নিজের পরিবর্তনকে কখনো সংস্কৃতিবিরোধী হিসেবে মনে করিনি।





ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপনে গুরুত্বারোপ : আমি মুসলিম সম্প্রদায়কে প্রথমে অনুধাবন করতে পারিনি। অনেক বিষয়কে আমার অদ্ভুত ও আচার-ব্যবহারকে বিভ্রান্তিকর বলে মনে হয়েছে। অভ্যন্তরীণ বিষয়ের চেয়ে বাহ্যিক বিষয়ের প্রতি অত্যধিক গুরুত্বারোপ আমাকে গভীরভাবে কষ্ট দিত। ইসলাম আমাদের ভালো কাজের বৈধতা ও মন্দ কাজ সংশোধনের সুযোগ দিয়েছে। ইসলামে সব কাজের ভারসাম্য বজায় রাখা হয়েছে। আমি মনে করি, মহানবী (সা.)-এর কথাগুলো আমাদের সব কাজে ভারসাম্য তৈরির মৌলিক ভিত্তি।
মন্দের জবাবে ভালো কাজ : মন্দ কাজের জবাবে ভালো ব্যবহার করবেন—এটাই মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা। মনে রাখবেন, আল্লাহ ন্যায়বিচার পছন্দ করেন। তাই মানুষ আপনার বিরুদ্ধে অন্যায় কাজ করলেও আল্লাহর সামনে আপনার নৈতিকতাবোধ ও বাধ্যবাধকতা আছে। ন্যায় পন্থার পক্ষাবলম্বন করে কখনো তা সীমা লঙ্ঘন করা যাবে না। ইসলামের নিজস্ব সৌন্দর্য উপলব্ধি করুন। আপনি যখন নিজের মধ্যে, সমাজ ও মানবকল্যাণে ইসলাম অনুসরণ করবেন তখন এর সৌন্দর্য ফুটে উঠবে।